রবিবার রাত ১০:০৫

২১শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১১ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

৮ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ গ্রীষ্মকাল

“কেমন আছেন পদ্মা পাড়ের পিতি রাণীরা”

সেই বিয়ান বেলা থেকেই চৈত্রের কাঠফাঁটা রোদ। যেন ভ্যাপসা-কাঠাল পাকানো গরম। চোখজ্বলা রোদের তপ্ত তেজ। ঘরের ঈশান কোণের ছাতিমগাছে গোদোম পাখি (পেঁচা) ধরপরানি ডাকছে। একটি সবুজাভ হরিয়াল (সবুজ বন কবুতর) বিনা নোটিশেই পিতি রাণীর কাঁধ ছুঁয়ে সবুজ মটমটি গাছের ঝোপে মিইয়ে গেল। পাশেই কলপাড়ে দ্রুতবেগে থালি মাজছেন পিতি রাণী।

পিতি রাণী। বয়স ৫৭। গায়ের রং কালো ভুসভূসা। ছাপা, রং জলা, তেসতেসে কাপড় পড়নে-কিন্তু বসন গুজার ঢং ভিন্ন। আলতো সিঁদুর দেয়া। হাতে শাঁখা। নাকে ছোট সোনাপুর। চেহারায় বয়সের ছাপ স্পষ্ট। তবে গড়নে-গঠনে শক্তির তেজিভাব।

মেশী রাণী গামলা ও বাটিতে দুপুরের খাবার গুছিয়ে নিচ্ছেন। আর আঙ্গিনা পরিস্কারে ব্যস্ত তিতি রাণী। খোঁচায় মুরগি আটকানোর কাজ শেষ করে সকলকে চরে যেতে তাড়া দিল নাফুতি রাণী। পিতি রানী, মেশি রানী, তিতি রানী ও নাফুতি রানীরা চার বোন। একসাথেই বসবাস।

রাজশাহীর পদ্মা গার্ডেন থেকে ৫-৬ কিমি দূরে তাদের যৌথ সংসার। আদিবাসী। বাঁশ,বেত,ছন ও খরের ঘর। পরিস্কার, কিন্তু আদি ভাব। সেকেলে বাসন-কোসন। ছয়টি ঘর-চৌচালা। বারান্দা আছে। বারান্দা জুড়ে চারটি টং। আঙ্গিনায় ছড়ানো একতলা-দোতলা পিড়ি। পতিবরগণ রুদামাল, তকিমাল, জুকিমাল ও তেউরিমাল পাসুন,নিড়ানি,নেকরা ও বাঁশ ডালা নিয়ে প্রস্তুত। পিতি রানি ইশারা দিতেই রওনা হয়ে গেল। ঘর থেকে বের হয়েই গনগনে আকাশের নিচে তারা দ্রুত হেঁটে পদ্মা পাড়ের দিকে চলল। এ মৌসুমে এটা তাদের নিত্য রোজগারের পথ। বেরিবাঁধ পর্যন্ত মিনিট পনেরোর হাঁটা পথ। এরপরই পদ্মার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল। ঠিক যেন এক নিসঃঙ্গ ধূধূ গোবি মরুভূমি। তাঁর উপরে অসীম অগ্নি নিঃসারক দিননাথ। আর এর বুকচিরে বয়ে চলেছে এক ফালি তরমুজের ন্যায় কীর্তিনাশা পদ্মা। প্রান্তর জুড়ে সূর্যের তেজ আর বালুকারাশির তেজ-এ যেন সমানে সমান বলীখেলা। এমনি জলন্ত দিগন্তই পিতি রাণীদের ক্ষুন্নিবৃত্তির একমাত্র ভেলা।

মহাকালগড়ের ডায়েরি-৩

বেরিবাঁধ থেকে মূল পদ্মার জলাঙ্গী ছোঁয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ বালুময় চরাঞ্চল। রয়েছে ছোট-বড় মিলিয়ে অসংখ্য বালিয়াড়ি। আর এসব জুড়েই গড়ে উঠেছে ছোট বড় মাঝারি চিরলি-বিরলি কাশবন। কিন্তু পিতি রানীরা এখানে কেশবতী পদ্মার কাশবনের সৌন্দর্য্য লোকনে কিংবা পদ্মস্নানে আসেনি।পদ্মার জলাঙে দক্ষিণী টান পড়ার সাথে সাথেই জাগতে শুরু করে পিতি রাণীদের ক্ষুন্নিভাগ্যের বিস্তীর্ণ চর বালাপাথার। আর তা আস্তে আস্তে রুপ নেয় গোবি মরুভূমির প্রান্তর স্বরূপ। কিন্তু পিতি রাণীদের কালো ঘামে এ নিস্ফলা-বন্ধুর- ব্যারেন প্রান্তরও হয়ে ওঠে গর্ভবতী। কী বিস্ময়!!প্রমত্তা পদ্মার এই পলি পড়া ধুধু মরুভূমির বুকেও সবুজ প্রাণের সঞ্চার ঘটে। চাষ হয় মসুরের ডাল, বাদাম,বাঙি, কুমড়োসহ নানা রকমের ফসলাদি। আর এর সাথে মুক্ত হয় পদ্মার ভাগ্যদেবীর বর স্বরূপ জন বন ও কাশবন।

মরুভূমি রূপান্তর হয় ফসলের দেশে। কিন্তু এ ফসল পিতি রাণীদের নয়, নয় মেশী রাণী বা তিতি রাণীর কিংবা নাফুতি রাণীর। তারা যেন পদ্মাপাড়ের ভাগ্যদেবী ‘পলিপদ্মিনী’ সৃষ্ট চিরায়ত ধারার কামলা বা বদল্যা। তাদের ভাগ্য দৈনিক ২৫০ টাকার উচ্চ পারদ রেখায় বন্দি। তাও আবার বছর জুড়ে নয়।সময়কাল বড়জোর ২১০ দিন।মূলত চর জাগার সাথে সাথেই তা প্রভাবশালী ভূপতিরা দখলে নেয়। অনেকটা জোর যার জমি তার এর মতো।ভূপতিরা জমির দখল নিয়ে তা মৌসুম-কনটাক্ট দেয়। আর মৌসুম-কন্টাকীরা দখলি ঐ জমিতে ফসল বুনতে সচেষ্ট হন। কন্টাকীদের পক্ষে জমির সাথে বীজের আত্মীয় ঘটান পিতি-রুদামালেরা। বুনন থেকে মাড়াই সবি করে তারাই। মোটে সাত মাস সময় পায় পিতি-তিতিরা। এসময়টা চরেই কাটে ওদের। এটা বছরের আয়ের মৌসুম। বাকি সময়ে অবসরের গৃহপনা।

১৩ মার্চ,২০২১। ঠিক দ্বিপ্রহর বেলা। পদ্মার চরে দেখা পিতি-তিতিদের সাথে। দলবেঁধে চরের বাউল্যানি ছন/কাশ বনে মসুরের ডাল তুলতে ব্যস্ত। দুর থেকে দেখলে মনে হয় তারা কাশিয়াবনে ডুবাডুবি খেলছে। আগ্রহ নিয়ে এগুতেই বুঝা গেল তারা কাজে নিমগ্ন। কামলা দলের পাশেই বসে তাড়া দিচ্ছে মৌসুম-কন্টাকী মোদাব্বের। ডান হাঁটুর উপরে একটি পুরান থ্রি-ব্যান রেডিও আবহসঙ্গীতের মত গেয়ে চলছে————————–“

বাড়ির পাশে বেতের আড়া

হাল জুড়াইছে ছুট্টো দেউড়া রে এ

এত বেলা হইল ভাবি জান

পন্তা নাই মোর পেটে রে এ————“

কি আকুল সুর! ব্যাকুল আবেগ! আর মায়াময় পরিবেশ! কেমন জানি বুকে-হৃদয়ে একটা অজানা-অচেনা কিন্তু আপন-আপন টান লাগলো। মিনেট সাতেক কথা হলো পিতি রাণীর সাথে। বেশ আন্তরিক। নির্মোহ। তৃপ্ত। এসময় এগিয়ে আসলো মেশী,তিথি ও নাফুতিরাও।

কথা শুরু করতে করতেই হঠাৎ আকাশটা কেমন জানি হয়ে উঠলো। গগন ঠাকুরের ইঙ্গিত সুবিধার নয়। তাই কথা খুব বেশি বাড়লো না। পাঁচ-ছয় হাত পশ্চিম দিকে দুপুরের খাবার রাখা। খাবারের গামলা পুরাতন লুঙ্গি ও তেনাবৃত। জল সমেত অ্যালুমিনিয়ামের কোচড়ানো জগ-গলা ভর্তি পানি গিলে নিশ্চল দাঁড়িয়ে।

দুপুরের খাবার —-জিজ্ঞেস করতেই বললো খাবেন নি। আমিও কেন জানি হু বলতেই তিতি রাণী গামলার ঢাকনা খুলে থালি এগিয়ে দিল। মোটা মালা ধানের লালচে সিদ্ধ ভাত। কিন্তু মায়াবিনাশী ধূলি-কুন্ডলি-বাতাস বাগড়া দেওয়ার উপক্রম। উপায়ান্তর না দেখে বেদিশা আমি বললাম শুধু তরকারিটা চেখে যাই। বলতেই সলজ্জ্ব বদনে-একটাই তরকারি বলে এগিয়ে দিল এক বাটি হল্যান্ডার আলুর ঝোল!!!খেলাম একপিছ! বিদায় নিয়ে তাড়াহুড়ো করে বেড়িবাঁধের দিকে দৌড় দিতেই শুরু হলো ঝড়ো-বৃষ্টি।

কিন্তু এই বৈরী আবহাওয়াতেও তারা নির্বিকার-কাজে মগ্ন।কিন্তু এই আমার মধ্যে কেমন যেন ওলটপালট হলো। এটা কি ওদের নিত্য আহার। পিতি-তিতির ঐ চোখ কি বললো আমায়। নাফুতি রাণীর শরমিন্দাভাব কি কখনও ভুলতে পারবে আমার বিবেক!!!

পুনশ্চ:এতো বছরেও কি আবু ইসহাকের “পদ্মার পলিদ্বীপ”এর সমাজ বাস্তবতায় তাদের খাবারে এক টুকরো মাংস জুটেনি। জুটেনি। জুটেনি।এই কি জীবন। এই কি বেঁচে থাকা। এই কি আমাদের যুগপৎ আধুনিকতার উল্টো পিঠ।এ দায় কি শুধু সাহিত্যিক আবু ইসহাকের—————

এসিল্যান্ড নরসিংদী সদর (শাহ আলম এসিল্যান্ড) মো: শাহ আলম মিয়া ,সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট, নরসিংদী সদর, নরসিংদী. এর টাইম লাইন থেকে নেওয়া।







© সকল স্বত্ব- সমাজ নিউজ -কর্তৃক সংরক্ষিত
২২ সেগুনবাগিচা, ৫ম তলা, ঢাকা- বাংলাদেশ।
ই-মেইল: news@somajnews.com, ওয়েব: www.somajnews.com
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি।

ডিজাইন: একুশে