শুক্রবার সন্ধ্যা ৬:৪৯

২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৮ই রমজান, ১৪৪৫ হিজরি

১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ বসন্তকাল

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গ্রাম হবিগঞ্জে- কমলা রাণীর দিঘী

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ইতিহাস ঐতিহ্যের লালনভূমি কিংবদন্তী গ্রামের নাম হবিগঞ্জের বানিয়াচং। বর্তমানে পৃথিবীর বৃহত্তম গ্রাম হিসেবে বানিয়াচং খ্যাতি লাভ করেছে। এক সময় বানিয়াচং ছিল প্রাচীন লাউড় রাজ্যের রাজধানী। মোগল আমল থেকেই তিলোত্তমা এ গ্রামটি শহর হিসেবে পরিচিত। আজ থেকে শ’ শ’ বছর পূর্বেই বিভিন্ন রূপ কথা ও কাব্যে বানিয়াচং শহর হিসেবে বিধৃত রয়েছে। প্রাচীন লোক সাহিত্যের স্বনামধন্য প্রকাশনা ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র দেওয়ানা মদিনা বিবির সংলাপে বানিয়াচঙ্গ এর উল্ল্যেখ রয়েছে এভাবে, ভাইয়েরে বুঝাইয়া কয়/ তুমি সোদর ভাই/তোমার কাছেতে মোর কিছুই গোপন নাই/তুমি যাও পরানের পুত্র সুরুযেরে লইয়া/কাসেমের খবর এক আনহ জানিয়া/আমার সগল কথা তাহারে বলিবা/তাহার মনের কথা যত সগল শুনিবা/এইনা বলিয়া বিবি পাঠায় তারারে/যাইতে যাইতে গেল তারা বাইন্যাচং শহরে।

গর্ব করার মতো ইতিহাস ঐতিহ্যে ভরপুর দেড় লক্ষাধিক লোক অধ্যুষিত এ গ্রামটির দীর্ঘ অবস্থান ভৌগোলিক ধারাকেও পাল্টে দিয়েছে। ‘কয়েকটি গ্রাম নিয়ে গঠিত হয় ১টি ইউনিয়ন’ ভূগোলের এ চিরায়িত ধারাটি বানিয়াচংয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, কারণ কয়েকটি গ্রাম নিয়ে ইউনিয়ন নয়, কয়েকটি ইউনিয়ন নিয়ে বানিয়াচং গ্রামের অবস্থান। ৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ৫ কিলোমিটার প্রস্থ বিশিষ্ট এ গ্রামটি ৪টি ইউনিয়ন ও ১২০টি মহল্লায় বিভক্ত। ভৌগোলিক সুদৃঢ় অবস্থানের কারণেই হয়তো প্রাচীনকালে এ গ্রামটি রাজধানী শহর হিসেবে সমাদৃত হয়েছিল।

তৎকালীন রাজা বাদশারা তাদের রাজধানী শহর বানিয়াচংকে সু-সজ্জিত করার জন্য এ গ্রামের প্রভূত উন্নয়নসাধন করেন। তন্মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য নিদর্শন ছিল প্রজাদের জল কষ্ট নিবারণে বিভিন্ন স্থানে বড় বড় দীঘি খনন। এ গুলোর মধ্যে কেশব মিশ্রের প্রপৌত্র রাজা পদ্মনাভ গ্রামের মধ্যবর্তী স্থানে খনন করিয়েছিলেন দেশের সর্ব বৃহৎ দীঘি। যা কমলা রাণীর দীঘি/কমলাবতীর দীঘি হিসেবে সুপরিচিত। ২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ১ কিলোমিটার প্রস্থ বিশিষ্ট ৬৫ একর জমির উপর খনন করা হয়েছে এ বিশাল দীঘি। এর খননের সাথে ১টি প্রাচীন লোক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে।

প্রচুর শ্রম ও অর্থ ব্যয় করে দীঘি খননের পরও নাকি পানি উঠছিল না। একদিন রাজা পদ্মনাভ স্বপ্নে দেখলেন, তার স্ত্রী কমলা রাণীকে দীঘিতে বিসর্জন না দিলে জল উঠবে না। অবশেষে উপায়ান্তর না পেয়ে সতীসাধধী ও প্রজা বৎসল কমলা রাণী প্রজাদের দুঃখ কষ্টের কথা ভেবে আত্মবিসর্জনে রাজি হলেন। নির্দিষ্ট দিনে বিষাদ পূজা সমাপ্ত করে হাজার হাজার প্রজাদের উপস্থিতিতে রাণী কমলা অশ্রুসিক্ত নয়নে চির বিদায় নিয়ে দীঘিতে নামলেন এবং তাকে তলিয়ে জলে ভরে উঠল পানি।

১৯৪২ সালে ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান জার্মান বিরোধী প্রচারণায় বনিয়াচঙ্গে এসে পল্লী কবি জসিম উদ্দিন এই দীঘির পাড়ে বসে রচনা করেছিলেন তার বিখ্যাত কবিতা, ‘কমলা রাণীর দীঘি’। যার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন প্রয়াত শিক্ষক হেমেন্দ্র চন্দ্র পোদ্দার ও সাবেক মন্ত্রী সিরাজুল হোসেন খান। কবিতাটি জসিম উদ্দিনের ‘সুচয়নী’ কবিতা সংকলনে স্থান পায়। এই কাহিনী নিয়ে একটি সিনেমা ও হয়েছে। ঐতিহাসিক এ দীঘিকে কেন্দ্র করে দিনাজপুরের রাম সাগর ও বরিশালের দূর্গা সাগরের মত উল্ল্যেখযোগ্য পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভব। এখনও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা পর্যটকরা এর নয়নাভিরাম দৃশ্য অবলোকণে পদার্পণ করে থাকেন।

দীঘির পশ্চিমে এলআর সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশ্ববর্তী একটি বাড়ীতে রয়েছে প্রাচীন রাজ প্রসাদের ধ্বংসাবশেষ। রাজা গোবিন্দ সিংহ ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর দিল্লী থেকে বানিয়াচঙ্গ ফিরে এসে দীঘির পাড়ে নির্মাণ করেছিলেন এ রাজ বাড়ী। পরিত্যক্ত রাজ প্রাসাদের পাশেই আছে কয়েকটি মসৃণ পাথরের স্তম্ভ। লোকজন এগুলোকে ‘হব্যা’  গোমা’র দাড়া গুড্ডি বলে। জনশ্রুতি আছে দৈত্য পরিবারের হব্যা ও গোমা দু’ভাই দীঘির পূর্ব ও পশ্চিম পাড়ে দাঁড়িয়ে এই স্তম্ভগুলো নিয়ে খেলা করত। আসলে হব্যা ও গোমা রাজা হবিব খাঁ ও গোবিন্দ সিংহ এই দু’টি শব্দেরই বিকৃত রূপ বলে ধারণা করছেন অনেকে।

নামকরণ বা অন্যান্য বিষয়ে মতবিরোধ থাকলেও বানিয়াচঙ্গ যে স্বাধীন  লাউড় রাজ্যের রাজধানী ছিল এটি অস্বীকার করার অবকাশ নেই। গ্রামের অসংখ্য ঐতিহাসিক নিদর্শনই এর অকাট্য প্রমাণ বহন করে। তৎকালীন রাজা বাদশারা তাদের রাজধানী শহর রক্ষার্থে গ্রামের চারদিকে প্রতিরক্ষা পরিখা হিসেবে তৈরী করেছিলেন আয়তক্ষেত্রের মত গড়ের খাল। এ খাল খননের সময় পাওয়া যায় রাজা আনোয়ার খাঁ’র সময়কার একটি ঐতিহাসিক কামান। যা বর্তমানে সিলেট পুলিশ লাইনে রক্ষিত আছে। এ ছাড়া দীঘির পাড়ে রাজা হবিব খা’র নির্মাণকৃত রাজবাড়ী এখনও রাজধানীর সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে। অন্যদিকে বানিয়াচঙ্গের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন পাড়া ও মহল্লার নামকরণেও প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রমাণ পাওয়া যায়। ত্বোপখানা, তীরকর মহল্লা, পাঠানটুলা, মজলিশপুর, সংগ্রাম রায়ের পাড়া, ঢালি মহল্লা এসব নামকরণ বিশ্লেষণ করলেও বানিয়াচঙ্গ যে লাউড়া রাজ্যের রাজধানী ছিল তা সন্দেহাতিতভাবে প্রমাণিত হয়।

স্বাধীনতাত্তোর বিভিন্ন সরকার বানিয়াচঙ্গের ঐতিহাসিক কমলারাণীর দিঘীটিকে ঘিরে পর্যটনকেন্দ্র স্থাপনের প্রতিশ্রতি দিয়ে আসলেও বরাবরই তা উপেক্ষিত হয়েছে। ১৯৯৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বানিয়াচং সফরে আসলে কমলারাণী দিঘীর পাড়ে বিশাল জনসভায় বক্তব্য রাখেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বানিয়াচংবাসীর একমাত্র দাবী ছিল কমলারাণীর দিঘীকে পর্যটনকেন্দ্র করার। এ দাবীর প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী জনসভায় কমলারাণীর দিঘীটিকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন। কিন্তু এরপরও এর কোন বাস্তবায়ন দেখতে পায়নি বানিয়াচংবাসী।

সম্প্রতি বানিয়াচং সফরে এসে দিঘী পরিদর্শনে যান বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী। বানিয়াচংবাসীর দাবীর মূখে তিনিও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন অচিরেই কমলারাণীর দিঘীটিকে পর্যটনকেন্দ্রে রূপান্তরিত করবেন। হবিগঞ্জের কৃতি সন্তান পর্যটন প্রতিমন্ত্রীর আশ্বাসে আবারও পর্যটনকেন্দ্র বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখছেন বানিয়াচংবাসী। পৃথিবীর বৃহত্তম এ গ্রামের ঐতিহ্য ও পুরাকীর্তি সংরক্ষণ এবং কমলারাণীর দিঘীটিকে পর্যটনকেন্দ্রে রূপান্তর এখন সময়ের দাবি।







© সকল স্বত্ব- সমাজ নিউজ -কর্তৃক সংরক্ষিত
২২ সেগুনবাগিচা, ৫ম তলা, ঢাকা- বাংলাদেশ।
ই-মেইল: news@somajnews.com, ওয়েব: www.somajnews.com
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি।

ডিজাইন: একুশে