শুক্রবার রাত ১:১১

২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৮ই রমজান, ১৪৪৫ হিজরি

১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ বসন্তকাল

দেশব্যাপী সংক্রমণ বৃদ্ধির শঙ্কা, নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে পালাচ্ছে মানুষ

একদিকে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ আতঙ্ক অন্যদিকে খাদ্যাভাব। তাই রাতের আঁধারে একরকম পালিয়েই শহর ছাড়ছেন নারায়ণগঞ্জের নিম্ন আয়ের মানুষ। লকডাউন উপেক্ষা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই পিকআপ ভ্যান, ট্রাক, বাল্কহেডে (পণ্যবাহী জাহাজ) করে  প্রায় প্রতিদিনই শত শত মানুষ পাড়ি জমাচ্ছেন নিজ নিজ জেলায়। এতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন করে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত ৪ দিনে নারায়ণগঞ্জ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় সহস্রাধিক মানুষকে আটক করা হয়েছে।

মঙ্গলবার (১৪ এপ্রিল) রাতে ফতুল্লা থেকে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষকে আটক করে পুলিশ। তাদের বহনকারী ৭টি পিকআপ, ১টি ট্রাক ও ১টি বাল্কহেডও আটক করা হয়। তাদের অধিকাংশই রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর ও কুষ্টিয়া জেলার স্থায়ী বাসিন্দা। 

অন্যদিকে, শনি থেকে সোমবার পর্যন্ত তিনদিনে আরও অন্তত ৫ শ’ মানুষকে নারায়ণগঞ্জ থেকে বিভিন্ন জেলার উদ্দেশ্যে যাওয়ার পথে আটক করা হয়। 

পুলিশ জানায়, রাত সাড়ে ১১টায় বাল্কহেডযোগে নদী পথে কিশোরগঞ্জে যাওয়ার পথে ফতুল্লার ধর্মগঞ্জ এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদীতে ধাওয়া করে একটি ট্রলার ও একটি বাল্কহেডসহ ৭০ থেকে ৭৫ জন যাত্রী,ফতুল্লার টাগারপার থেকে কিশোরগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া ৩টি পিকআপসহ দেড় শতাধিক যাত্রী, মাউরাপট্টি থেকে কিশোরগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করা দুই শতাধিক যাত্রীসহ চারটি পিকআপ আটক করা হয়। একই সময় ফতুল্লার পঞ্চবটী থেকে কিশোরাগঞ্জ যাওয়ার পথে সাইনবোর্ড এলাকায় প্রায় ৬০ জন যাত্রীসহ একটি ট্রাক আটক করা হয়। 

ফতুল্লা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসলাম হোসেন জানান, আটক যাত্রীদের ফেরত এনে যার যার বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। গাড়িগুলোকে থানা হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।

তিনি জানান, কাজকর্ম বন্ধ থাকায় খাবারের সমস্যা এবং করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে তারা নারায়ণগঞ্জ ছাড়ছিলেন। 

এদিকে, এখনও নারায়ণগঞ্জ  থেকে অন্য জেলায় মানুষের যাতায়াতের কারণে করোনাভাইরাসে সংক্রমণ ঝুঁকিতে পড়ছে দেশের অন্যান্য জেলা শহরগুলোও। 

উল্লেখ্য, সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ থেকে বিভিন্ন জেলায় গেছেন প্রায় প্রতিদিনই এমন কেউ না কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হচ্ছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন মারাও গেছেন।

রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) বলছে, ঢাকাসহ দেশের অন্তত ২১টি জেলায় করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লেও সবচেয়ে বেশি কমিউনিটি সংক্রমণ হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ জেলায়। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যানুযায়ী, গত ৮ মার্চ থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত এ  ৩৮ দিনে নারায়ণগঞ্জে করোনা ভাইরাসে ডাক্তার, নার্স, সাংবাদিকসহ আক্রান্ত হয়েছেন ১৭০ জন আর  ৩০ মার্চ থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ১৪ জনের। এছাড়া প্রায় প্রতিদিনই করোনা ভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে মারা যাচ্ছেন কেউ না কেউ।

তাই এই জেলাকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জেলা অর্থাৎ রেড জোন (করোনা ক্লাস্টার) হিসেবে আখ্যায়িত করেছে আইইডিসিআর । 

এমন পরিস্থিতিতে গত ৮ এপ্রিল থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ জেলাকে সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ (লকডাউন) ঘোষণা করা হয়। সন্ধ্যা ৬টার পর বাড়ির থেকে বেরোলেই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে।

কিন্তু এত কড়াকড়ি সত্ত্বেও এখনও মানুষ নারায়ণগঞ্জ থেকে অন্যান্য জেলায় যাচ্ছেন। বিষয়টি জেলা প্রশাসন ও পুলিশের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে বলে মনে করেন সচেতন মহল।

তবে এ বিষয়ে প্রশাসন কঠোর অবস্থানে রয়েছে বলে দাবি জেলা প্রশাসন ও পুলিশের। তারা বলছেন, ইতোমধ্যেই নারায়ণগঞ্জের সড়কও নৌ-পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কাউকে যেতে কিংবা ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। উপজেলাগুলোতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছেন ম্যাজিস্ট্রেটরা।

জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, নারায়ণগঞ্জের মোট জনসংখ্যা ৩১ লাখ ৫৭ হাজার ১৪ জন। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের ভোটার সংখ্যা মাত্র ১৭ লাখ ২৫ হাজার ৫৮৯ জন। শিল্পনগরীর কারণে জেলায় অস্থায়ী মানুষের সংখ্যা বেশি। এসব মানুষের অধিকাংশই গার্মেন্টস শ্রমিক, রিকশা চালক, দিনমজুর । যাদের অনেকেই বিভিন্ন মৌসুমে নারায়ণগঞ্জে আসেন উপার্জনের আশায়।

এদিকে, জেলা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, অনেক বাসায়ই তালা ঝুলছে। কেউ কেউ এখনও প্রস্তুতি নিচ্ছেন যাওয়ার জন্য।  

গত ৬ তারিখে বেতন পাওয়ার পর পরই তিন মেয়ে নিয়ে ঠাঁকুরগাওয়ে চলে গেছেন দেওভোগ পাক্কা রোড এলাকার বাসিন্দা রিকশা চালক নজরুলের স্ত্রী ফরিদা বেগম। নজরুল বলেন, “লকডাউনের আগেই বউ মাইয়াগো নিয়া চইলা গেছে। আমি কাল পরশু রওনা দিমু। শুনছি  সব বন্ধ। তবুও সমস্যা হইবো না। লোক আছে,যাইতে পারমু।”

এদিকে, নারায়ণগঞ্জের ভোটার না হওয়ায় ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন অনেকেই।

এই পরিস্থিতিতেও জেলা থেকে মানুষ অন্যান্য জেলায় যাওয়ার বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সেলিম রেজা বলেন, “আমরা অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি যাতে মানুষ ঘর থেকে বের হতে না পারে। প্রতিটি অলিগলিতে  প্রতিদিন ম্যাজিস্ট্রেটরা অভিযান চালাচ্ছেন।  তবুও মানুষ বের হয়ে যাচ্ছে।”

তবে লকডাউন ঘোষণার পর থেকে এমন মানুষের সংখ্যা খুব কম বলে দাবি করেন তিনি।

জেলা পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম বলেন, “আমরা সড়ক ও নৌ-পথ বন্ধ করে দিয়েছি। লকাডাউন ঘোষণার পর থেকে  আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পুলিশ, নৌ পুলিশ, র‌্যাব সবাই নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করেছি। প্রতিটি থানায় কমিটি গঠন করে পুলিশি টহল জোরদার করা হয়েছে।”

তারপরেও মানুষ বিভিন্নভাবে বেরিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, গত তিনদিনে  নারায়ণগঞ্জ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় প্রায় ৫০০ মানুষ আমরা আটক করেছি। এখনও আটক হচ্ছে। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি যাতে নারায়ণগঞ্জ থেকে মানুষ বের হয়ে অন্যজেলাগুলোতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে।







© সকল স্বত্ব- সমাজ নিউজ -কর্তৃক সংরক্ষিত
২২ সেগুনবাগিচা, ৫ম তলা, ঢাকা- বাংলাদেশ।
ই-মেইল: news@somajnews.com, ওয়েব: www.somajnews.com
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি।

ডিজাইন: একুশে