প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, করোনাভাইরাস এমন এক শত্রু, যা মানুষের বেঁচে থাকাকে চ্যালেঞ্জ করছে এবং এ মুহূর্তে শুধুমাত্র নিজেরা বেঁচে থাকবো এমন মানসিকতা কোনও কাজে আসবে না। এই ভাইরাস মোকাবিলায় এখন প্রয়োজন সম্মিলিত দায়িত্ববোধ ও অংশীদারের মানসিকতা সম্পন্ন একটি ব্যবস্থা।
বৃহস্পতিবার (২৩ এপ্রিল) সন্ধ্যায় ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম আয়োজিত দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক স্ট্র্যাটেজি গ্রুপের প্রথম ভার্চুয়াল সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রীর দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্যের ভূয়সী প্রশংসা করেন ফোরামের চেয়ারম্যান বর্গ ব্রেনডে। সভায় কিনোট স্পিকার ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বর্তমান সমস্যাকে জটিল আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতিসংঘের নেতৃত্বে বহুপাক্ষিক ব্যবস্থা সামনের দিকে এগিয়ে আসা উচিত।’
ধনী দেশগুলোর সংস্থা জি-৭, জি-২০ এবং অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) নেতৃত্বের প্রয়োজনের ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম এবং জাতিসংঘের মহাসচিবের উচিত ভবিষ্যৎ নীতি নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন সরকারের সঙ্গে কথা বলা ও বৈশ্বিক ব্যবসাকে নেতৃত্ব দেওয়া।’
করোনাভাইরাসের কারণে বৈশ্বিক ব্যবসা, কর্মক্ষেত্র ও উৎপাদনে বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে এবং কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে নতুন ব্যবস্থার উদ্ভব হবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি অনেক বৈশ্বিক ব্র্যান্ড দায়িত্বশীল আচরণ করছে না। বাংলাদেশের মতো দেশগুলো যাতে নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, সেজন্য আমাদের কৌশল ও বাস্তব সম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর বড় প্রভাব পড়েছে এবং এটি মোকাবিলায় বাংলাদেশ ইতোমধ্যে এক হাজার ১২৫ কোটি ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে এবং এর প্রাথমিক লক্ষ্য হচ্ছে অভ্যন্তরীণ ও রফতানিমুখী খাত, সামাজিক নিরাপত্তা বলয় বৃদ্ধি ও কৃষিখাতকে সহায়তা দেওয়া।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘কৃষকদের চেষ্টার কারণে এ অঞ্চলে যথেষ্ট খাদ্য আছে কিন্তু এই সমস্যা দীর্ঘায়িত হলে এটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোসহ অন্যান্যদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে।’
বাংলাদেশের কৃষি খাতের জন্য ৩০০ কোটি ডলার বরাদ্দ রাখা হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী আর বলেন, ‘আমরা এক কোটি দরিদ্র ও প্রান্তিক পরিবারকে নগদ সহায়তা দেবো এবং এর মাধ্যমে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ উপকৃত হবে।’
বাংলাদেশে ১১ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে এবং তারাও সরকারের বড় কৌশলের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
ভাইরাস মোকাবিলায় বাংলাদেশ টেস্টিং কিট, গ্লোভস, মাস্ক, পিপিই যোগাড় করছে এবং কিছু বাংলাদেশি উদ্যোক্ত নিজেরাই এটি তৈরি করছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা নিজেরাই ভেন্টিলেটর বানানোর প্রক্রিয়ায় রয়েছি। আমাদের বেসরকারি খাত হাজার হাজার রোগীর চিকিৎসার জন্য হাসপাতালের ব্যবস্থা করছে। আমাদের ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা সামনে থেকে কাজ করছেন।’
প্রধানমন্ত্রী জানান, বৃহৎ জনগোষ্ঠির কারণে আমরা প্রথমে আক্রান্ত অঞ্চলকে লকডাউন করার চিন্তা করেছিলাম, তবে পরবর্তীতে গত সপ্তাহ থেকে আমি কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছি।
দারিদ্র্য ও অসমতা বৃদ্ধি পাবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গত এক দশকে আমরা গরিব জনগোষ্ঠির অর্ধেককে দারিদ্র্যসীমার উপরে নিয়ে এসেছি। তবে তাদের অনেকে এখন আবার পিছিয়ে পড়বে।’
জনগণ ঋণের ফাঁদে পড়তে পারে আশঙ্কা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘৮৫ শতাংশ বাংলাদেশি ইনফরমাল খাতে কাজ করে এবং আমাদের ছোট ও মাঝারি খাত বড় ধরনের বিপদের সম্মুখিন।’
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যদেশগুলোরও অবস্থা একই রকম জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মানুষের মঙ্গলের জন্য, অসমতা ঠেকানোর জন্য, দরিদ্র জনগোষ্ঠির সহায়তার জন্য এবং কোভিড-১৯ পূর্ববর্তী অবস্থায় ফেরত যাওয়ার জন্য বিশ্বকে এখন নতুনভাবে চিন্তা করা প্রয়োজন।’
অভিবাসী শ্রমিকরা ধনীদেশগুলোতে প্রচুর অবদান রাখছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কিন্তু তারা এখন চাকরিচ্যুতসহ বিভিন্ন ধরনের বিপদের মধ্যে আছে। এরফলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো ঝুঁকির মধ্যে আছে। এজন্য সবার মধ্যে দায়িত্ব বণ্টনের মাধ্যমে আমাদের যৌক্তিক গ্লোবাল কমপ্যাক্ট তৈরি করতে হবে।’
গত এক দশক ধরে এটুআই প্রোগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশে ডিজিটাইজেশন হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভবিষ্যতে নিজেদের তৈরি থাকার জন্য আমরা উদ্ভাবনি উপায় বের করতে পারি। বিশেষ করে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি ও সাপ্লাই চেইন খাতের জন্য। এজন্য বাংলাদেশ ফোরামের সহযোগিতা চায়।’
করোনাভাইরাস সমস্যা মোকাবিলার জন্য ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম কোভিড-১৯ গ্লোবাল অ্যাকশন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে, যেখানে ১০০০ বৃহৎ কোম্পানি যোগ দিয়েছে। এই প্ল্যাটফর্মের আওতায় ছয়টি আঞ্চলিক গ্রুপ তৈরি করা হয়েছে, যার মধ্যে দক্ষিণ এশিয়া গ্রুপ একটি।
বৈঠক শেষ হওয়ার পরে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ফেলো ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর আইসোলেশনিস্ট পলিসি বা একলা চলা নীতির বিরুদ্ধে অবস্থানের ভূয়সী প্রশংসা করেন ফোরামের চেয়ারম্যান ব্রেনডে।’
দীর্ঘদিন ফোরামের সঙ্গে যুক্ত সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল বাংলাদেশের একজন অংশগ্রহনকারী হিসেবে ওই বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন। শহীদুল বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর স্ট্র্যাটেজি থেকে রোহিঙ্গারাও বাদ পড়েননি এবং খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি বৈঠকে ব্যাপক প্রশংসিত হয়।’
তিনি জানান, আগামী ১৪ মে ফোরাম আবার টেকনিক্যাল বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য মিলিত হবে এবং সেখানে আরও বিস্তারিতভাবে বিষয়টি আলোচিত হবে।
ভারত, নেপাল, ভূটান, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুরের নীতি-নির্ধারক ও বড় বড় ব্যবসায়ীরা বৈঠকে অংশ নেন।