হাজি কাসেম আলীর (৫৫) প্রতিবছরই রোজার এই সময়টায় দম ফেলানোর ফুরসত থাকত না। সেই সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায় ইফতারি তৈরির ব্যস্ততা। দোকানে এই এক মাসের জন্য তাঁকে দুই-তিনজন লোক বেশি রাখতে হয়। নাহলে কুলানো যায় না। পুরান ঢাকার ইফতার বলে কথা। কত কত পদ তৈরি রেখে রোজদারদের খুশি রাখতে হয়। আর ঐতিহ্য বলে তো একটা কথা আছে। এর টানেই মানুষ আসে তাঁর দোকানে।
কিন্তু এবার হাজি কাসেমের সেই ব্যস্ততা নেই। ফলে তার মনও ভালো নেই। দোকান বন্ধ। কর্মচারীরা গ্রামে চলে গেছে। তিনিও প্রায় এক মাস ধরে হাত-পা বেঁধে ঘরে বসে আছেন। তবু সকালে বেরিয়ে দোকানের সামনে এসে ঘুরে যান। দুপুরে বেরিয়ে আবার বাসায় চলে যান। মন মানে না। এই সময়ে কত চিল্লাচিল্লি হতো, মানুষ আসত, বেচাকেনা শেষে আজান শুনে দোকানে বসেই সবাইকে নিয়ে ইফতারের আয়োজন করতেন তিনি।
হাজি কাসেম আজ বলছিলেন, ‘এইবার তো কিচ্ছু নাই। সব ফাঁকা। মানুষই নাই, দোকান নাই, ইফতার নাই। করোনার জন্য সব বন্ধ। রুজি-রোজগারও নাই। ঈদ কেমন হইব।’
প্রতিবছর চকবাজারের সড়ক বন্ধ করে চলত ইফতারের দোকান বসানোর নানা কর্মযজ্ঞ। কিন্তু এবার সেই চিত্র নাই। রাস্তায় বসেনি কোনো দোকান, নেই বিক্রেতাদের ব্যস্ততাও। চাইলেই এবার মিলবে না ‘বড়ো বাপের পোলায় খায়’ এর মতো ইফতারি।
মাসব্যাপী চলা এই ইফতার বাজারে মিলতো নানান মুখরোচক খাবার। যেগুলোকে বলা যেতে পারে পুরান ঢাকার ‘ট্রেড মার্ক‘। চাইলেই এগুলো পুরান ঢাকার মতো অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না। বটি কাবাব, সুতা কাবাব, রেশমি কাবাব, জালি কাবাব থেকে শুরু করে ১০ থেকে ১২ ধরনের কাবাব মিলত এই রোজায়। আস্ত খাসি ভুনা, আস্ত কোয়েল ভুনার পাশাপাশি এখানে পাওয়া যেত নানান ধরনের টিকিয়া। শাহী জিলাপি, মাঠাসহ অন্তত ২০ ধরনের মিষ্টিদ্রব্য রোজদাররা এখান থেকে বাসায় নিয়ে যেতেন। লোকেঠাসা পুরান ঢাকা এই করোনাভাইরাসের কারণে একেবারেই ফাঁকা। মানুষ রোজা রাখছেন কিন্তু ইফতারির আজেমটা উধাও হয়ে গেছে।
দুপুরের দিকে চকবাজারের দু-একজন পথ চলতে চলতে বলছিলেন, কী আর করা যাবে! বাসাতেই যা সম্ভব তৈরি করে নেবে। ইফতারি তো করতে হবে। আগের মতো আর হবে না আর কি।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকান, ফার্মেসি হাসপাতাল বাদে অন্য সব দোকানপাট বন্ধ রাখার নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। এই মহামারিতে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব নয় বলে ইফতারির দোকানও বন্ধ।
রমজানে আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখার জন্য ফুটপাতে ইফতার বিক্রির কার্যক্রম বন্ধ রাখতে নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ। চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মওদুদ হাওলাদার বলছিলেন, ‘এবার চকবাজারের ঐতিহ্যবাহী ইফতার বাজার বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
দেশে গত ২৬ মার্চ থেকে ঘোষিত সাধারণ ছুটি তিন দফা বাড়িয়ে ৫ মে পর্যন্ত করা হয়েছে। এ সময়ে বিনা প্রয়োজনে কাউকে বাইরে না আসতে এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলাচলের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।