রবিবার রাত ৮:৩৩

৬ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

২রা রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

২১শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শরৎকাল

ফেসবুক: কী দেয় কী নেয়?

চারদিকে দুঃসংবাদ। কিন্তু সব দুঃসংবাদ সমান না। তারপরও আমরা অনেকেই দুঃসংবাদ ঘিরে কষ্ট পাই, রাগান্বিত হই। একটা কষ্ট আরেকটা কষ্টের কথা মনে করিয়ে দেয়। ক্রমবর্ধিতভাবে সব এক হয়ে যায়, রাগ বাড়তে থাকে। অথবা আমরা তা-ই মনে করি। তবে মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষ যখন একই ধরনের ঘটনা বারবার দেখতে থাকেন বা উপলব্ধি করতে থাকেন, যেমন ধরুন, জ্বলন্ত বাস অথবা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হিংসাত্মক কোনো ভিডিও, তাঁদের মস্তিষ্ক বুঝতে পারে না যে তাঁরা বিচ্ছিন্ন ঘটনা দেখছেন। বরং মস্তিষ্ক মনে করে সব ঘটনা এক।

দুই পা পেছাই

আজকাল সামাজিক মাধ্যম তথা ফেসবুক/টুইটারের কারণে আমরা আগের থেকে অনেক বেশি তথ্য বা খবর পাই। গণমাধ্যমের খবরও সেখানে সহজলভ্য। শুধু দেশ বা তারকাদের নিয়ে নয়, আমাদের বন্ধু/শত্রু নিয়েও আমরা জানতে পারি। যেসব দেখে আমরা লাভবান হচ্ছি, সেটার কথা আপাতত থাক। থাক, কারণ সেটাও বড় গল্প—অসম উন্নয়ন ও আয়বৈষম্যের গল্প, প্রতিযোগিতা ও আর্থসামাজিক অবস্থানের গল্প।

বরং নজরে আনতে চাই বিশেষ এক সমস্যার কথা: যার নাম মানসিক সমস্যা

আজকাল ফেসবুকে লাইভ স্ট্রিমিং করার উপায় আছে। নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল আছে অনেকের। তাঁরা তাঁদের জীবন ও জীবনধারার গল্প বলতে আসেন। যথেষ্ট মানুষ তা জানতে ইচ্ছুক। এটা মনে করিয়ে দেয় ছোটবেলায় ডায়েরি লেখার কথা, এবং বন্ধুদের ডায়েরি পড়ার কথা। যখন আমরা বন্ধুরা একে অন্যের ডায়েরি পড়া শুরু করলাম, আমাদের ডায়েরি লেখার ধরন ও বিষয় পাল্টে গেল। সেটাই স্বাভাবিক। গণমাধ্যমে যা হচ্ছে, সেটা আমাদের ডায়েরি লেখার মতো। আমরা দেখছি, মানুষের এক মুখ, যেটাকে তাঁরা প্রাধান্য দেন, অথবা যেই ভাবমূর্তি তাঁরা গড়তে চান। অন্য অনেক কিছু চাপা পড়ে যাচ্ছে।

এটার একটা মানসিক প্রতিফলন আছে। গবেষকেরা যাচাই করে দেখেছেন, যাঁরা ফেসবুকে বা টিভির সামনে বেশি সময় কাটান, তাঁদের বিষণ্নতা রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি। তার নানা কারণ আছে, যেমন নিজেকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করে নিজেকে ছোট ভাবা, অসুন্দর ভাবা। অথবা অন্যের বিদেশ ঘুরে আসার ছবি দেখে ভাবা, ইশ্‌, আমি তো যেতে পারি না! মূলত সমস্যাটা হয় কারণ মানুষ নিজের জীবনকে অন্য মানুষের মাপকাঠি দিয়ে যাচাই করতে শুরু করে। নিয়মিতভাবে এ রকম হতে থাকলে মানুষের আত্মসম্মানবোধ ও নিজের সম্পর্কে ধারণা পাল্টাতে থাকে।

গণমাধ্যমে আমরা দেখছি আরও একটা চিত্র: হিংস্রতা

অনেকেই দেখেছেন বর্ণবাদী পুলিশের হাতে খুন হওয়া বেশ কিছু মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের শেষ মুহূর্তগুলো। অনেকেই দেখেছেন রাজনকে কী নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। এমনকি আমরা এক তরুণীর লাইভ স্ট্রিমে দেখেছি তাঁকে আত্মহত্যা করতে। ১৩ ঘণ্টা ধরে মৃত্যুর পরিকল্পনা করে, আয়োজন করে অবশেষে তিনি নিজের জীবন নিয়ে নেন। সব লাইভ। তা-ও তাঁকে বাঁচাতে সক্ষম হননি কেউ। তা-ও সময়মতো কেউ তাঁকে দেখেননি। সেই তরুণী হয়তো এটাই প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে আমরা সব দেখেও কিছুই দেখি না। দেখলেও তা উপলব্ধি করতে পারি না। বুঝি না বা জানি না কী করণীয়।

বিস্ময়কর যে এখন আর যায়-আসে না কোন দেশে, কোন স্থানে এসব ঘটনা ঘটছে—আমরা সব দেখছি, জানছি। বারবার। সে জন্যই আমাদের আরও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।

এবার সেই আগের কথায় ফিরে যাই, যখন বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকে, এবং আমরা তা দেখতে থাকি, আমাদের মস্তিষ্ক বোঝে না যে এগুলো সব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। যাঁদের জীবনে মানসিক বা শারীরিক আঘাতের ইতিহাস আছে, ইংরেজিতে আমরা যেটাকে ‘ট্রমা’ বলে থাকি, এসব ঘটনা সেসব পুরোনো ক্ষত আবার তাজা হতে পারে। তার মানে, তাঁরা তাঁদের জীবনের ট্রমা নতুন করে আবার উপলব্ধি করতে পারেন, তার দ্বারা মানসিকভাবে আক্রান্ত হতে পারেন আবার। কিন্তু তার মানে এই না যে তাঁরা এসব ভিডিও উপেক্ষা করে চলেন; বরং তাঁদের মধ্যে কাজ করে দুটি জিনিস—তাঁরা এসব বারবার দেখতে থাকেন (অবসেশন) এবং এতে কষ্টও পেতে থাকেন।

কিন্তু যাদের ইতিহাসে কোনো ট্রমা নেই, তাঁদের জন্যও এসব হিংস্রতা দেখা ক্ষতিকর। একদিকে এ রকম হিংস্রতা দেখে মানুষ শেখে হিংস্র হওয়ার কায়দা-কানুন। একই সঙ্গে শেখে যে হিংস্র হওয়াটা বোধকরি স্বাভাবিক। সম্মিলিতভাবে এসব দেখে দেখে আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাই। তখন এটা ‘কালচার’-এ পরিণত হয়। কারণ আমরা এই ধরনের বার্তা অনেক জায়গা থেকেই পাই। এসব ধারণার পালে হাওয়া দেয় কিছু ধরনের গান, সিনেমা, এমনকি কোনো কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের বক্তব্য। এসব ধারণা জোড়া লেগে লেগে শেষ পর্যন্ত একটা মতবাদের মতো হয়ে ওঠে, যা বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা-নিপীড়ন ও বৈষম্যকে মানিয়ে নিতে ও স্বাভাবিক বলে ভাবার দিকে ঠেলে দেয়।

এরপর যখন আমরা সংঘাত-সহিংসতার মুখোমুখি হই, আমরা তা মেনে নিই—কারণ সেটাও আমাদের ওই সহিংস মতবাদের সঙ্গে মিলে যায়। এবং আমরা চুপ করে থাকি, প্রতিবাদ করি না। কারণ আমরাও তো মেনে নিয়েছি, শিখেছি, কীভাবে সংঘাত কাজে লাগাতে হয়। শিখেছি, সংঘাত-উত্তেজনা মানুষকে ব্যস্ত রাখে। এভাবে মানুষকে তটস্থ ও ব্যস্ত রাখা গেলে অনেক ধরনের ফায়দা লোটা সম্ভব। বিশ্বজুড়ে এই ব্যস্ত রাখার খেলা চলছে, কারণ এই খেলাটা ভালো জমে। জনগণ খুশি, তাঁদের শাসকেরাও খুশি, ফায়দাবাজ ব্যবসায়ীরাও খুশি।

তবে ফায়দা লোটার সমস্যা কী, আমরা অনেকেই জানি। আরেকটু কম জানি মানসিক চাপ সম্পর্কে। এটার প্রমাণ হলো যে আমরা এখনো মানসিক সমস্যাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারি না। এটা একটা অসুখ, ধরুন ক্যানসারের মতো। তবু আমরা আমাদের মানসিক রোগে আক্রান্ত আত্মীয়দের লুকিয়ে রাখি, তাঁদের বন্ধু কেউ হতে চায় না। তাঁরা পাগল। কেন জানি তাঁরা ঠিক মানুষ না। তাঁদের আশা আকাঙ্ক্ষা নেই। তাঁরা ভালো-মন্দ বোঝে কি না, তা-ও আমরা জানতে চাই না। তাঁদের আমরা অবশ্য ঠিক জানিয়ে দিই, তাঁরা আমাদের বোঝা, তাঁরা আমাদের কলঙ্ক। এমনকি আমরা তাঁদেরই দোষারোপ করি তাঁদের রোগের জন্য। নানা ভাষায় নানাভাবে গালাগালি করি।

কিন্তু আমরা সবাই যে মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা রাখি, তার কী হবে? আমরা কি নিজেদের এখন বাথরুমে আটকে রাখব?

হয়তো তা-ই করা উচিত কারণ আমাদের যা পাওনা, তা-ও আমরা পাই না। যদি চাই, প্রতিবাদ করি, আমাদের ব্যস্ত অথবা উদাসীন জীবন থেকে সরে এসে, তখন আমাদের শাস্তি পেতে হয়। এ রকম অবস্থাতেই প্রতিবাদ করার কারণে শাহবাগে একজন শিক্ষার্থীর চোখ কেড়ে নাওয়া চলে। একজন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রের আঁকা ছবির অছিলায় একজন ইউএনওকে জেলহাজতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা যায়, ৫৭ ধারার মামলা হয় শিক্ষক-সাংবাদিক ও আইনজীবীর বিরুদ্ধে। এসব চলছে তার একটা কারণ হয়তো এই যে আমরা ঠিকমতো প্রতিবাদ করিনি। হয়তো করিনি কারণ আক্রান্ত ব্যক্তিরা ক্ষমতাশালী নন। তাঁরা চলে গেলেও আমাদের নিজেদের জীবন ঠিকই থাকবে। তা ছাড়া আমরা যে ব্যস্ত! সময় কোথায় এত কিছু বোঝার? খবর জানতে জানতেই তো দেরি হয়ে যায়।

আর কোনোক্রমে যদি সময় মেলে, আমাদের হয়তো ভাবতে হবে, পরিস্থিতি কত খারাপ হলে মানুষ একটা ছোট ছেলের আঁকা ছবি নিয়ে এ রকম হুলুস্থুল করেন। অথবা কাকে খুশি করার জন্য কারা এসব পদক্ষেপ নেন। এটাও যাচাই করা দরকার, এটাতে তাঁরা আসলেই খুশি হচ্ছেন কি না।







© সকল স্বত্ব- সমাজ নিউজ -কর্তৃক সংরক্ষিত
২২ সেগুনবাগিচা, ৫ম তলা, ঢাকা- বাংলাদেশ।
ই-মেইল: news@somajnews.com, ওয়েব: www.somajnews.com
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি।

ডিজাইন: একুশে